ফারুক হোসেন মজুমদার: নন্দিত কণ্ঠশিল্পী বেবী নাজনীনের জন্মদিন আজ। প্রতি বছর এই দিনে অগণিত ভক্ত-শ্রোতার ভালোবাসায় সিক্ত হন তিনি। তাঁর অনিন্দ্য কণ্ঠ, গায়কি, আর সৃষ্টি নিয়ে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসেন অনুরাগীরা। এবার তাঁর ব্যতিক্রম হবে না বলেই ভক্তরা আশা করছেন। তবে এই মুহূর্তে বেবী নাজনীন তাঁর জন্মদিন ঘটা করে উদযাপনের পক্ষে নন।
তিনি জানান, স্বৈরশাসকের পতনের পর এখন সময় দেশ গড়ার। তাই প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছে দেশ ও জনগণের স্বার্থে কাজ করে যাওয়ার। সাধারণ মানুষের নানাবিধ সংকট ও সমস্যার সমাধান, আগামী বাংলাদেশ নিয়ে তাদের যে প্রত্যাশা, তা পূরণের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।তবে রাজনৈতিক পরিচয়ের আগে দেশবাসীর কাছে তাঁর পরিচিতি একজন কণ্ঠশিল্পী হিসেবে। এ কারণে এই শিল্পীর কাছে প্রথম প্রশ্ন ছিল তাঁর নতুন গান কবে প্রকাশ পাবে?
এর উত্তরে বেবী নাজনীন বলেন, ‘গত কয়েক বছর প্রশ্ন কত শত ভক্ত-শ্রোতার কাছে যে শুনতে হয়েছে, তার হিসাব মেলানো কঠিন। শুধু তাই নয়, প্রশ্নের উত্তরে কাউকে কোনো প্রতিশ্রুতিও দিতে পারিনি। কারণ, গত ১৫-১৬ বছর আমি এই দেশেই থাকতে পারিনি। গান গাইব কী করে? বিগত স্বৈরশাসকের কারণে দেশে বারবার আমার পেশাগত কাজকর্ম বাধাগ্রস্ত হয়েছে। টেলিভিশন ও মঞ্চ একজন শিল্পীর গানের প্রধান মাধ্যম। অথচ এই দুই মাধ্যম থেকে আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ফলে অনেক গানের কাজ শুরু করেও শেষ করতে পারিনি। তবে আশার কথা হলো, আটকে থাকা কাজগুলো নিয়ে শেষ করার জন্য নতুন করে উদ্যোগ নিয়েছে। সে হিসেবে কথা দিতে পারি, শিগগিরই আমার নতুন গান শোনার সুযোগ পাবেন শ্রোতারা।’
এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে যে প্রশ্ন সামনে উঠে আসে তা হলো– দেড় দশকের বেশি সময় পর দেশের সংগীতাঙ্গনে ফিরে কী পরিবর্তন চোখে পড়ছে? এর জবাব দিতে গিয়ে বেবী নাজনীনের প্রশ্ন, ‘এখন কি গানের সেই ইন্ডাস্ট্রি আছে? গান সৃষ্টির বড় যে দুই মাধ্যম, সেই অডিও ইন্ডাস্ট্রি নেই, চলচ্চিত্র অঙ্গন তো আগের মতো নেই। এককথায়, নতুন গান সৃষ্টির বড় দুই মাধ্যম এখন অধুনালুপ্ত। এতে বাংলা গানের ভবিষ্যৎ নিয়ে সুখকর কিছু দেখছি না। নতুন গান ও নতুন শিল্পী তৈরি হওয়াও এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।’তাহলে কি গানের ভুবনে আশার আলো দেখা যাবে না? এ প্রশ্নে ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড-খ্যাত এই শিল্পী বলেন, ‘আমি নিরাশাবাদী নই, কারণ আমি চিরকাল মন্দের পরাজয় দেখে এসেছি। এই যে আমরা একটা কঠিন সময়ের ঘোরচক্রে আটকে ছিলাম, সেই বেড়াজাল থেকে কি মুক্তি ছিনিয়ে আনতে পারিনি? পেরেছি। গানের ভুবনেও বদল আসবে। এখন কী হচ্ছে? এর উত্তর খুঁজতে গেলে চোখে পড়বে, শিল্পী ও সংগীতায়োজকরা নিজেই ইউটিউব চ্যানেল খুলে গান প্রকাশ করে যাচ্ছেন। অনেকে তো নিজের গানের ভিডিও তৈরি করছেন নিজ উদ্যোগেই। এভাবে দুই-একজনের দুই-চারটা গান হয়তো আসে এবং আসবে, কিন্তু এতে বাংলা গানের প্রসার আগের মতো হবে না। এখন যেহেতু গানে বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা নেই, সেহেতু এ বিষয়ে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে বাংলা গান আর সমৃদ্ধ হবে না; ঐতিহ্য দিনদিন ফিকে হয়ে যাবে। তাই বিষয়গুলোয় সঠিক নজরদারি রাখতে হবে, যাতে করে সংগীতাঙ্গন তার হারানো জৌলুস ফিরে পায়।’
শিল্পীর এ কথা থেকে দেশের সংগীতাঙ্গনের একটা স্পষ্ট অবয়ব যেমন আমাদের সামনে উঠে এসেছে, তেমনি সংকট মোচনের পথের দেখাও মিলিছে। তারপরও যে বিষয়টা এখনও অনেকে মনে প্রশ্ন তোলে, তা হলো– রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন সময় শিল্পী, গীতিকবি, সুরকার, সংগীতায়োজকরা যেভাবে বঞ্চনার শিকার হয়েছেন, তার কোনো প্রতিকার মিলবে কিনা?
এ নিয়ে বেবী নাজনীন বলেন, ‘অন্য কেউ নয়, নিজেকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেই বলি, যে ১৫-১৬ বছর আমি প্রবাসে আটকে থেকেছি, দেশে আসতে পারিনি এমনকি দেশীয় প্রচার মাধ্যমেও উপেক্ষিত ছিলাম, সেই আমি কতটা কষ্ট বুকে চেপে ছিলাম, তাকি সবাই বুঝবে? বুঝবে তারাই, যারা এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন। আমার বিশ্বাস, রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে বঞ্চনার শিকার শিল্পী, গীতিকবি, সুরকার, মিউজিশিয়ান সবাই এ বিষয়ে রুখে দাঁড়াবে। কেউ চাইবে না, অতীতের ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটুক। প্রতিটি শিল্পী যেন স্বাধীনভাবে প্রচার মাধ্যমগুলোয় নিজস্ব সৃষ্টি ও প্রতিভা তুলে ধরার সুযোগ পান– সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখব।’
জন্মদিনে নন্দিত এই শিল্পীর মুখে এমন আশার বাণী অনেকের মুখে হাসি ফোটাবে– এটুকু অনুমান করে নেওয়াই যায়। পাশাপাশি এই প্রত্যাশাও করা যায় যে, গানে গানে শ্রোতা হৃদয় স্পর্শ করার পাশাপাশি বেবী নাজনীন তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়কে আলোকিত করবেন।প্রসঙ্গত, ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড’ ও ‘উত্তরবঙ্গের দোয়েল’-খ্যাত শিল্পী বেবী নাজনীনের সংগীত ক্যারিয়ার চার দশকের বেশি সময়ের। দীর্ঘ এই সংগীত সফরে তিনি টিভি, চলচ্চিত্র, বেতারসহ দেশ-বিদেশের মঞ্চে গান করে কুড়িয়েছেন অগণিত শ্রোতার ভালোবাসা। তাঁর গাওয়া ‘এলোমেলো বাতাসে উড়িয়েছি শাড়ির আঁচল’, ‘কাল সারা রাত ছিল স্বপনেরও রাত’, ‘দুচোখে ঘুম আসে না’, ‘মানুষ নিষ্পাপ পৃথিবীতে আসে’, ‘ওই রংধনু থেকে’, ‘পত্রমিতা’, ‘মরার কোকিলে’, ‘আর কতদিন’, ‘লোকে বলে আমার ঘরে নাকি চাঁদ উঠেছে’, ‘প্রিয়তমা’সহ আরও অসংখ্য গান আজও শ্রোতাদের মনে অনুরণন তুলে যাচ্ছে।
অনিন্দ্য কণ্ঠ আর অনবদ্য গায়কির জন্য তিনি ভূষিত হয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অগণিত পুরস্কার ও সম্মাননায়। সংগীত সাধনার পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়েও এখন ব্যস্ত সময় কাটে এই শিল্পীর। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল– বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছেন।
Add Comment