ঠিক তখনই দলের সঙ্গ ছেড়ে ড্রেসিংরুমে নিজেকে আড়াল করতে চাইলেন মাহমুদউল্লাহ। মাথা নিচু করে ক্যামেরার ফ্রেম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন নীরবে। পেছন থেকে একজনের ডাকে তাঁকে থামতে হয়। পেছনে ফিরে তাকাতে হয়। ওহ, আরও একটা ছবি তোলা বাকি। এবারের ছবিটা টিম ম্যানেজমেন্ট, টিম বয়দের সঙ্গে ক্রিকেটারদের। মাহমুদউল্লাহকে তাই ফিরে আসতে হয়। কিন্তু তিনি এসে দাঁড়ালেন সবার পেছনে, একদম কোনায়।

সেখান থেকে তিনিই পরিচালকের ভূমিকায় ছবির ফ্রেমটা ঠিক করে দিলেন। একটু আগের ছবিটায় যারা সামনে ছিলেন, তাদের একটু পিছিয়ে টিম বয়দের ট্রফি নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াতে বললেন। মাহমুদউল্লাহর সাজানোর ফ্রেমেই তোলা হলো জয়ী দলের ছবি। যেখানে মাহমুদউল্লাহ নিজেকে রাখলেন একদম পেছনের সারিতে, কোনায়। এরপর নীরবে সরে এলেন ক্রিকেটারদের ভিড় থেকে। নিজেকে লুকিয়ে নিলেন ড্রেসিংরুমে।
দৃশ্যপট দুই:
ভারতীয় অধিনায়ক রোহিত শর্মা মাত্রই মোস্তাফিজুর রহমানের ইয়র্কার মিস করেছেন। চোখ বুজে হাতের ব্যথা হজম করছিলেন । মোস্তাফিজ তখন দুই দফা বুনো উদ্যাপন করে ফেলেছেন। সঙ্গে পুরো বাংলাদেশ দলও। ভারতকে আরও একবার সিরিজে হারাল বাংলাদেশ। উদ্যাপন তো হবেই।
মাহমুদউল্লাহ এমন সময় দৃশ্যপটে এলেন। হতাশ রোহিতের পিঠ চাপড়ে দিলেন হাতে তিন সেলাই নিয়েও অবিশ্বাস্য লড়াই করার জন্য। ওদিকে বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা একজন আরেকজনকে অভিনন্দন জানাতে ব্যস্ত।

দলটা এরপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল। বিসিবির কর্মকর্তারা মাঠে। তাদের আত্মীয়স্বজনরাও এসেছেন খেলা দেখতে। জয়ের নায়ক মেহেদী হাসান মিরাজের সঙ্গে সবাই ছবি তুলছেন। ইবাদত হোসেনের সঙ্গেও ছবি তোলার অনেক চাহিদা। আর সাকিব আল হাসান তো আছেনই। এর মধ্যেই পুরস্কার বিতরণ হলো।
কিছুক্ষণ পর আবার শুরু হলো সেলফি শিকার। বাংলাদেশ দলের ড্রেসিংরুমের সামনে কখনো মিরাজ, কখনো সাকিব কিংবা ইবাদতকে নিয়ে জটলা বেঁধে যাচ্ছে। মোস্তাফিজুর রহমান ও নাসুম আহমেদ এ সময় যোগ দিলেন সে দলে। তাদের সঙ্গে সেলফি তোলা নিয়েও টানাটানি শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে। বাংলাদেশ সিরিজ জিতেছে ভারতের বিপক্ষে। তাতে যাদের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল তাদের নিয়েই এত উন্মাদনা।
তখন ওই দূরে দাঁড়িয়ে মাহমুদউল্লাহ। বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান ও তাঁর পরিচালনা পর্ষদের অনেকেই ছিলেন মাঠে। পুরস্কার বিতরণ পর্ব শেষ হতে না হতেই বোর্ড প্রধান ও পরিচালকরা চলে এলেন ক্রিকেটারদের জটলায়। সেখানে পুরো দলের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলার পর ছবি তোলা পর্ব শুরু হলো—বোর্ড প্রধান, পরিচালক ও ক্রিকেটারদের সিরিজ জয় পরবর্তী ছবি। বলার অপেক্ষা রাখে না, সেই ছবির একদম কোনায় দাঁড়িয়ে মাহমুদউল্লাহ। মুখে হাসি। যা ক্যামেরার জন্য।

ছবি তোলা শেষ হতে না হতেই মাহমুদউল্লাহ সরে দাঁড়ালেন। নীরবে এগোলেন ড্রেসিংরুমের দিকে। মিরাজ, সাকিব, ইবাদতরা তখনো বোর্ড প্রধানের পাশে দাঁড়িয়ে। তখন এক ফটো সাংবাদিকের খেয়াল করলেন যে ছবিতে সিরিজ জয়ী অধিনায়ক লিটনই নেই! তিনি বোর্ড প্রধান নাজমুল হাসানকে বললেন, ‘পাপন ভাই, লিটন ছিল না ছবিতে। লিটন সহ ছবিটা আবার তুলি।’ ততক্ষণে মাহমুদউল্লাহ ড্রেসিংরুমের সামনে। তাঁকে যেতে দেখেই পেছন থেকে একজনের ডাক, ‘রিয়াদ ভাই, লিটন ছিল না ছবিতে। আরেকবার আসেন।’
অথচ ৬৯ রানে ৬ উইকেট হারানো বাংলাদেশকে যে জুটিটা ২৭১ রানে পৌঁছে দিয়েছে, সে জুটিটা মাহমুদউল্লাহকে ছাড়া কল্পনাই করা যায় না! ৯৬ বল খেলে তিনি ৭৭ রান করেছেন ৭টি চারের সৌজন্যে। বাংলাদেশকে তিনি এমন মঞ্চে পৌঁছে দিয়েছেন, যেখানে দাঁড়িয়ে দ্রুত রান তোলা সম্ভব।
ভারতীয় দলের হয়ে টি-টোয়েন্টিতে এ দায়িত্বটা পালন করেন দীনেশ কার্তিক। কাল চেন্নাইতে বসে বাংলাদেশ-ভারতের ম্যাচ দেখছিলেন এই ভারতীয়। বাংলাদেশের সিরিজ জয়ে মাহমুদউল্লাহর ইনিংসের অবদানটা কার্তিকের মুখেই শুনুন, ‘বাংলাদেশ দলে সে আছেই এই দায়িত্ব পালনের জন্য। মিডল ওভারের চাপটা সে নিতে পারে। যা তাঁর সবচেয়ে বড় শক্তি। আর আমরা জানি শেষের দিকে সে কি করতে পারে। আজ আউট হওয়ার আগে ঠিক সেটাই করেছে মাহমুদউল্লাহ। তাঁর জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল ৬০ রানে ৬ উইকেটের মতো অবস্থা থেকে দলকে একটা নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়া। ঠিক সেটাই সে করেছে।’
কিন্তু প্রচারের আলো মাহমুদউল্লাহকে খুঁজে পায় না বললেই চলে। তিনি যে সব সময় আড়াল খুঁজে চলেন!
Add Comment